ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে বাবার কবর জিয়ারত করতে চেয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে ঢাকার চারদিক থেকে লাখ লাখ মানুষের গণভবনমুখী অভিযাত্রার কারণে তিনি সে সুযোগ পাননি। প্রবল গণরোষে জীবন হারানোর শঙ্কায় সশস্ত্র বাহিনীর ব্যবস্থাপনায় তাকে দ্রুত দেশত্যাগ করতে হয়। তবে এর এক ঘণ্টা আগেও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে গণবিক্ষোভ দমন করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ঘটনাবহুল সেই সময়ে গণভবনে দায়িত্ব পালনকারী একটি সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
এদিকে, বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদত্যাগের এক দিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার সময় শেষ হয়ে গেছে।
বিভিন্ন সূত্র ও বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, রোববার সকালে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে শেখ হাসিনা দুটি বিকল্প খোলা রাখতে চেয়েছিলেন। একটি, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলপ্রয়োগ করে ক্ষমতা ধরে রাখা। কিন্তু শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা শেখ হাসিনার কথায় রাজি হননি। আলাদাভাবে বৈঠকে সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, সেনারা বেসামরিক লোকজনের ওপর গুলি চালাবেন না। তবে তারা পুলিশকে নিরাপত্তা সহায়তা দিতে পারবেন। অন্যদিকে, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, তাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে।
নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকের পর বাস্তব পরিস্থিতি উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা নৈরাজ্যবাদীদের কঠোর হস্তে দমন করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। এর মধ্য দিয়ে তিনি মূলত বিক্ষোভ দমনে নিজ দলের নেতাকর্মীদের উসকে দিয়েছিলেন।
সংঘর্ষের ভয়াবহতা স্পষ্ট হয়ে উঠলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ঢাকামুখী গণমিছিলের কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে আনার ঘোষণা দেন। এ বিষয়ে দেওয়া গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়, ছাত্রদের দাবি মানুষকে আকৃষ্ট করছে। পরদিন (সোমবার) হাজারো মানুষ রাজধানীর রাজপথে নামার পরিকল্পনা করছে। এই পরিস্থিতিতে রোববার সন্ধ্যায় তিন বাহিনীর প্রধানরা আবারও শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। তারা বিনয়ের সঙ্গে ব্যাখ্যা করে বলেন, মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। সোমবার সকালে ঢাকায় হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটতে পারে। তারা গণভবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না। এর পরও শেখ হাসিনা তিন বাহিনীর প্রধানদের পরামর্শ গ্রহণ করেননি।
সূত্র জানায়, ওই দিনই (রোববার) দেশে আসেন শেখ রেহানা। কঠোর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গণভবনে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সোমবার সকাল থেকেই ঢাকা অভিমুখে বিপুল জনতার যাত্রা শুরু হয়। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আবার শেখ হাসিনার বাসভবনে গিয়ে তাকে পরিস্থিতির গভীরতা ব্যাখ্যা করছিলেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঢাকার অনেক জায়গা থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করা হচ্ছিল। সেনাপ্রধান শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, তারা খুব বেশি সময় গণভবনে জনতার প্রবেশ ঠেকাতে পারবেন না। সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা বা তার কিছু বেশি সময় তা সম্ভব হতে পারে। এই পর্যায়ে সামরিক প্রধানরা শেখ হাসিনাকে বোঝানোর জন্য তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর প্রধানরা তখন শেখ রেহানার সঙ্গে কথা বলেন। রেহানা নানাভাবে বড় বোনকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শেখ হাসিনা উল্টো বারবার শেখ রেহানাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেন। জানান, তাকে মেরে ফেলার পর যেন বাবার কোলে শুইয়ে দেওয়া হয়। শেখ রেহানা তখন অঝোরে কাঁদতে থাকেন এবং জানিয়ে দেন, বোনকে রেখে তিনি কোথাও যাবেন না।
কোনোভাবেই বোঝাতে না পেরে রেহানা তখন সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে দিয়ে শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে রাজি করানোর চেষ্টা করতে থাকেন। ছেলে, মেয়ে ও বোনের জোর প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে রাজি হন শেখ হাসিনা। এরপরই তিনি ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহযোগিতা চান। তিনি ভারতীয় বিমান পাঠিয়ে তাকে সেদেশে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ভারত সরকার জানায়, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তারা বাংলাদেশের আকাশসীমায় ভারতীয় বিমান নিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। তবে যে কোনো উপায়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে ভারতের মাটিতে প্রবেশ করলে তারা তাকে সহযোগিতা করবে।
এরপর শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনীর কাছে দুই দিন সময় চান। কিন্তু তাকে মাত্র ৪৫ মিনিট সময় দেওয়া হয়। কারণ বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারী তখন যেখানে অবস্থান করছিলেন, সেখান থেকে গণভবনে আসতে এর চেয়ে বেশি সময় লাগবে না।
এরপর শেখ হাসিনা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পদত্যাগের নথিতে স্বাক্ষর করেন। তিনি দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে একবার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং টুঙ্গিপাড়ায় তার বাবার কবর দেখতে যেতে চেয়েছিলেন। নিরাপত্তা বিবেচনায় তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। সর্বশেষ তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে দুই মিনিটের ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। তবে তখন আর হাতে সময় ছিল না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, চার বা পাঁচটি স্যুটকেস উড়োজাহাজ বা হেলিকপ্টারে ওঠানোর জন্য রাখা ছিল।
এক ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, শেখ হাসিনা কখন পদত্যাগপত্রে সই করেছেন, কখন সামরিক হেলিকপ্টারে উঠেছেন, তা শুধু স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স, প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট ও সেনা সদরের কিছু ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা জানতেন। পুরো ব্যাপারটা গোপনে করা হয়েছিল। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের স্থানীয় সময় সোমবার দুপুর প্রায় ১টা ৩০ মিনিটে শেখ হাসিনাকে হেলিকপ্টার থেকে বিমানে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় বোন রেহানা ছাড়াও ব্যবসায়ী নেতা সালমান এফ রহমান তার সঙ্গে ছিলেন। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের তথ্য অনুযায়ী,
চলে যাওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে উঠতে অনিচ্ছুক ছিলেন।