তাছলিমা তমাঃ নয় বছর আগে জামালপুরের রুবেল মিয়া (২৮) ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন। ছয় বছর চাকরি করেন তিনি। ধাপে ধাপে বেতনও বাড়ে। তবে তা ছিল ঢাকা শহরে টিকে থাকার মতো। কিন্তু এ সময়ে বদলে গেছে রুবেলের জীবন। তাঁর ১৩টি ব্যাংক হিসাবে ৩৫ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে। আর যে টাকা তিনি ব্যাংকে (এফডিআর ও ডিপিএস) জমা করেছেন, তার পরিমাণও কোটি টাকার বেশি।
২০১৯ সালে রিলায়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ওয়ে নামে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা শুরু করেন রুবেল মিয়া। তাঁর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অনুসন্ধান করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসার আড়ালে রুবেল মিয়া মানব পাচার, স্বর্ণ চোরাচালান ও মুদ্রা পাচার করে কয়েক বছরের ব্যবধানে বিপুল অর্থের মালিক বনে গেছেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন দমানোর অসৎ উদ্দেশ্যে মোঃ রুবেল মিয়ার ব্যবসায়িক পার্টনার জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজ এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আওয়ামী সন্ত্রসী বাহিনির সদস্যদের সাথে যোগ সাযোস করে অবৈধ অস্ত্র এবং অর্থের যোগান দাতা মোঃ রুবেল মিয়া উত্তরাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ছাত্র হত্যার সাথে প্রত্যক্য এবং পরোক্ষ ভাবে সরাসরি জড়িত সেই সাথে যারা বিএনপি পন্থি ব্যবসায়ি ছিলেন তাদেরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসায়িকদের কে ব্যবসা করতে দেয়নি এবং ডিবি দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে জিম্মি করে নির্যাতন করত। সেই সাথে ব্যবসা না করার জন্য হুমকি দামকি প্রদান করত। আর এখন নিজের প্রতিষ্ঠান নিজেদের লোক দিয়ে লুটপাট করে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে রুবেল মিয়া বলেছেন, হয়রানির উদ্দেশে তাঁর বিরুদ্ধে এসব মামলা দেওয়া হয়েছিল। তিনি যত দিন চাচার প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন, তত দিন কোনো সমস্যা হয়নি। ওই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে নিজে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়া হয়েছিল। তবে রুবেলের চাচা শাহজাহান এই প্রতিবেদক কে বলেছেন, তিনি রুবেলের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করেননি। তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে চলে যাওয়ার পর রুবেলের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।
রুবেল মিয়া বলেন, ‘আমার মাত্র ছয়টা ব্যাংক হিসাব। একটা ব্যাংক হিসাবে আছে ১৫ হাজার টাকা। আরেকটি ব্যাংক হিসাবে আছে ২০ হাজার টাকা। এই দুটি ব্যাংক হিসাবের তথ্য সিআইডি তার মামলায় উল্লেখ করেনি। মামলায় উল্লেখ করা বাকি ব্যাংক হিসাবগুলো আমার নয়।’ রুবেলের আইনজীবী শাহিনুর ইসলাম দাবি করেন, তাঁর মক্কেল রুবেল মিয়ার আয়ের উৎস ব্যবসা। তিনি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন।
তবে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (ঢাকা মহানগর উত্তর) ফয়সাল আহমেদ বলেন, রুবেল মিয়া সিঅ্যান্ডএফ অফিসে কর্মরত থাকলেও মূলত তিনি মুদ্রা পাচার ও স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত। মুদ্রা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকায় ২০২১ সালের একটি মামলায় রুবেল মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর বিমানবন্দর থানার একটি মুদ্রা পাচার মামলার তদন্ত করতে গিয়ে গত বছরের অক্টোবরে রুবেল মিয়ার নাম প্রথম জানতে পারে সিআইডি। পরে ওই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে মানব পাচার প্রতিরোধে আইনে মামলা হয়।
রুবেল মিয়া বর্তমানে দুই মামলাতেই জামিনে আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সম্প্রতি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেছে সিআইডি।
রুবেলের নাটকীয় উত্থান
রুবেলের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে। মামলার তথ্য বলছে, ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তাঁর তেমন কোনো আয় ছিল না। ২০১৩ সালে তিনি জামালপুর থেকে ঢাকায় আসেন। পাঁচ হাজার টাকা বেতনে সিনথিয়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করেন। ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিক তাঁর চাচা শাহজাহান। ২০১৯ সাল পর্যন্ত চাচার প্রতিষ্ঠানে রুবেল চাকরি করেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে তাঁর বেতন বেড়ে হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। সিআইডি বলছে, এ সময়ে ব্যাংকের হিসাব বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেতন–ভাতা বাবদ রুবেলের আয় ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
সিআইডির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে রুবেল মিয়ার কয়েকটি ব্যাংক হিসাবে আটটি এফডিআরে টাকার পরিমাণ ছিল ৯০ লাখ ১৫ হাজার ৪৯৩ টাকা রয়েছে। আর ২০টি ডিপিএসে মোট ৩২ লাখ ৯৯ হাজার ৯১৯ টাকা জমা হয়েছে।
রুবেল মিয়ার বিরুদ্ধে করা তিনটি মামলার কাগজপত্রের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ইউনাইটেড সার্ভিস এজেন্সি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের রপ্তানিপণ্যের কার্টনে বিমানবন্দরে স্ক্যানিংয়ে ৫৪ হাজার সৌদি রিয়াল ও ২০ হাজার সিঙ্গাপুরিয়ান ডলার পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ঢাকা কাস্টমস হাউস কর্তৃপক্ষ হাসান আলী ও ইয়াসিন নামের দুজনকে আসামি করে মামলা করে। পরে এ মামলার তদন্ত করতে গেলে চক্রের সদস্য হিসেবে রুবেলের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায় সিআইডি।
ব্যাংক হিসাবের তথ্য পর্যালোচনা করে সিআইডি দেখতে পায়, রুবেল ও তাঁর ১০টি প্রতিষ্ঠানের মোট ৩৬টি ব্যাংক হিসাব। তার মধ্যে ১৩টি ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেন হয়। এসব অ্যাকাউন্টে গত বছরের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৫ কোটি ৬৫ লাখ ৯৯ হাজার ৪১৪ টাকা জমা হয়। আর তুলে নেওয়া হয় ৩৫ কোটি ১১ লাখ ৩২ হাজার ৭১৩ টাকা। বর্তমানে তাঁর ব্যাংক হিসাবগুলোতে আছে ৫৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে রুবেল মিয়া বলেন, ‘আমার কোম্পানি হয় ২০১৯ সালে। কোম্পানির নামে ব্যাংক হিসাব খুলেছি। আমার কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে আমদানিকারক কিন্তু টাকা পাঠায়। সরকার নির্ধারিত কর পরিশোধ করে আমদানি করা পণ্য ছাড় করে দিই।’
মানব পাচারের অভিযোগ
ইতালিতে পাঠানোর নাম করে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে রুবেল মিয়ার বিরুদ্ধে গত বছরের ১৭ অক্টোবর রাজধানীর তেজগাঁও থানায় মামলা করেন সবুজ নামের এক ব্যক্তি। মামলায় তিনি বলেন, রুবেল শ্রমিক ভিসায় বিদেশে লোক পাঠানোর মধ্যস্থতাকারী। রুবেল মিয়া ১২ লাখ টাকায় তাঁকে ইতালিতে পাঠানোর আশ্বাস দেন এবং লিখিত চুক্তিও হয়। গত বছরের ১০ এপ্রিল রুবেল তাঁর কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা নেন। পরে ওই বছরের ২১ এপ্রিল তাঁকে দুবাই পাঠানো হয়। এরপর তাঁকে জিম্মি করে বাংলাদেশে তাঁর পরিবারের কাছ থেকে আরও ৬ লাখ টাকা আদায় করা হয়। এরপরও তাঁকে ইতালিতে পাঠানো হয়নি। দুবাইয়ে রুবেলের লোকজন তাঁকে মারধর করেন। পরে স্বজনদের সহযোগিতায় তিনি দেশে ফিরে আসেন। মানব পাচারের ওই মামলায় রুবেলকে গত বছরের ২৩ অক্টোবর গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
সবুজ বলেন, মামলা করেও তিনি এখনো কোনো টাকা ফেরত পাননি। মানব পাচার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তেজগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নুর আলম খান বলেন, রুবেল মিয়া মানব পাচারে জড়িত রয়েছেন, সেটা প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।