আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পট-পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা ও সাজা সম্পর্কিত নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্দেশনায় দলপন্থি স্থানীয় আইনজীবীরা দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে গিয়ে এসব তথ্য সংগ্রহের কাজ করছেন। যাতে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হলে দ্রুততম সময়ে কেন্দ্রীয়ভাবে আইনজীবীদের কাছে এসব তথ্য সরবরাহ করা যায়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দেশে ফেরার পরিবেশ সৃষ্টিতে দলের একটি বিশেষ সেলের তত্ত্বাবধানে এই কাজটি চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তারেক রহমানের মামলাগুলোর আইনি প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়টি দলীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার। দল থেকে নির্দেশনা পেলেই তারা আইনি প্রক্রিয়ায় নামবেন। তবে আইনি প্রক্রিয়া শুরুর ব্যাপারে দলীয়ভাবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সম্প্রতি গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে তারেক রহমানের কয়েকজন আইনজীবীর সাথে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বৈঠক হয়েছে। সেখানে তারেক রহমানের মামলাগুলো নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আইনি প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়েও আইনজীবীদের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, তারেক রহমানের মামলা ও সাজার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন এবং পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝে দলীয় সিদ্ধান্তে তার আইনজীবীরা আইনি প্রক্রিয়া শুরু করবেন। তাদের আশা, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মামলা ও সাজা থেকে মুক্ত হবেন, ন্যায় বিচার পাবেন। তাদের দাবি, তারেক রহমানের সবগুলো মামলা মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি ওয়ান-ইলেভেন সরকার এবং সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, আইনি প্রক্রিয়াসহ প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হবেন তারেক রহমান। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় রয়েছেন। তাদের প্রত্যাশা, দ্রুততম সময়ে তিনি দেশে ফিরবেন।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ গতকাল কালবেলাকে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর দেশের মানুষ তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষা করছে। বিএনপির নেতাকর্মীসহ সবার প্রত্যাশা, উনি দ্রুততম সময়ে দেশে ফিরবেন। উনার যাতে স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রত্যাবর্তন হয়, সেজন্য আমরা পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছি। যথা সময়ে তিনি দেশে ফিরবেন।
দেড় দশকের বেশি সময় ধরে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন তারেক রহমান। বর্তমানে তিনি দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে অবস্থান করছেন। লন্ডন থেকেই দল পরিচালনা করছেন তিনি। তারেক রহমানের নেতৃত্বেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের একদফা দাবিতে বছরের অধিকালব্যাপী আন্দোলন করে বিএনপি। কিন্তু বিএনপির আন্দোলন ও বর্জনের মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে বিএনপি। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে বিএনপি। একই সঙ্গে নতুন সরকারের কার্যক্রম এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ওপরও নজর রাখছে দলটি।
তারেক রহমানের আইনজীবীরা জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারাদেশে শতাধিক মামলা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে মানি লন্ডারিং, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানহানি এমনকি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাও আছে। ওয়ান-ইলেভেনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা হয়। বাকি মামলাগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের। ইতোমধ্যে পাঁচটি মামলায় তারেক রহমানের সাজা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় তার ১০ বছর দণ্ড হয়। অর্থ পাচারের একটি মামলায় ২০১৩ সালে বিচারিক আদালতের রায়ে তিনি খালাস পেলেও পরে উচ্চ আদালত তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন।
জানতে চাইলে তারেক রহমানের আইনজীবী ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল কালবেলাকে বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সর্বদাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। উনার বিরুদ্ধে যতগুলো মামলা দায়ের করা হয়েছিল, সেগুলোর প্রতিটিই ছিল ভিত্তিহীন। উনাকে রাজনৈতিক কারণে সাজা দেওয়া হয়েছে। তারপরেও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তার মামলাগুলো মোকাবিলা করা হবে।
আইনি প্রক্রিয়া কখন শুরু হবে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যথাসময়ে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
২০০১ সালে বিএনপির নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারেক রহমান রাজনীতিতে সক্রিয় হন। দেশে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে আটক করা হয়। সে সময় তাকে ১৩টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়। ১৮ মাস পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে জেল থেকে বের হন। আট দিন পর ১১ সেপ্টেম্বর তিনি দেশ ছেড়ে যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেই থেকে তারেক রহমান সপরিবারে লন্ডনে অবস্থান করছেন।
এরমধ্যে ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হলে ওইদিনই কারাবন্দি হন। এরপর থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তারেক রহমান। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে সফল হয়নি।
তারেক রহমান লন্ডনে থেকেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির পরামর্শে দল পরিচালনা করছেন। বিএনপি নেতারা জানান, তারেক রহমানের নেতৃত্বেই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের একদফার আন্দোলন হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও তিনি সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন।
তারেক রহমান লন্ডনে যাওয়ার পর থেকেই বিএনপির তরফ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছিল, চিকিৎসার জন্য তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন। তবে পরবর্তীতে জানানো হয়, তিনি লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, ২০১২ সালে তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন এবং এক বছরের মধ্যেই সেটি গৃহীত হয়।