আলোচিত অভিনেত্রী পরীমণির সঙ্গে সম্পর্কের জেরে এবার চাকরি হারাচ্ছেন সাবেক ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনারের (এডিসি) দায়িত্বে থাকা গোলাম সাকলায়েন।
পরীকাণ্ডে আলোচনা শুরুর পর প্রথমে সাকলায়েনকে ডিবি থেকে সরিয়ে মিরপুরের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) সংযুক্ত করা হয়েছিল। পরে সেখান থেকে তাকে ঝিনাইদহ ইনসার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয়।
এবার পরীকাণ্ডে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর আবেদন করা হয়েছে সেই সাকলায়েনকে।
গত ১৩ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা-২ শাখা থেকে উপসচিব রোকেয়া পারভিন জুঁই স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করার জন্য আবেদন করা হয়।
শৃঙ্খলা শাখার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সাকলায়েন ধারাবাহিকভাবে নায়িকা পরীমণির বাসায় নিয়মিত রাত্রিযাপন করতে শুরু করেন।
বিভিন্ন সময়ে (দিনে ও রাতে) নায়িকা পরীমণির বাসায় সাকলায়েন অবস্থান করেছেন বলে মোবাইলের ফরেনসিক রিপোর্ট দেখে প্রমাণ পাওয়া যায়।
রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, তার ও পরীমণির আদান-প্রদানকৃত
মেসেজসমূহ (২৯ জুলাই, ২০২১ তারিখ হতে ৩ আগস্ট, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত) সামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমণির ফেসবুক আইডি ও গোলাম সাকলায়েন সিথিল নামে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথোপকথন এবং তাদের হোয়াটসৃআ্যাপ নম্বরে (১১
জুলাই, ২০২১ তারিখ হতে ৪ আগস্ট, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত) কথোপকথন সাধারণ পরিচিতি বা পেশাগত প্রয়োজনে স্থাপিত কোনো সম্পর্কের নয়। বরং অনৈতিক প্রেমের সম্পর্ক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১ আগস্ট, ২০২১ তারিখ ভোর ৬টা থেকে ২ আগস্ট, ২০২১ তারিখ রাত ৩টা পর্যন্ত রাজারবাগ মধুমতি পুলিশ অফিসার্স কোয়ার্টার্সে নায়িকা পরীমণির যাতায়াতের ধারণকৃত সিসিটিভি ফুটেজের ফরেনসিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণেও প্রমাণ পাওয়া যায়।
সাকলায়েন বিবাহিত ও এক সন্তানের বাবা হওয়া সত্ত্বেও পরীমণির সঙ্গে তার বিবাহবহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, পরীমনির সঙ্গে জন্মদিন উদযাপন ও নিজের সরকারি বাসভবন নিজ স্ত্রীর অবর্তমানে সময় কাটানোর মতো ঘটনা বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে তা প্রচারিত হওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। উল্লিখিত অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি পর্যালোচনাপূর্বক অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করে তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী অসদাচরণ এর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় একই বিধিমালার বিধি ৪ এর উপবিধি ৩(ঘ) বিধি মোতাবেক গুরুদণ্ডের আওতায় কেন তাকে চাকরি হতে বরখাস্তকরণ করা হবে না সে মর্মে ২য় কারণ দর্শানো নোটিশ প্রদান করা হয়। অভিযুক্তের কারণ দর্শানোর নোটিশ স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় যথাযথ জারির প্রমাণ রয়েছে (সংলাগ-চ)।
সাকলায়েন, ২য় কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব চাকুরী হতে বরখাস্তকরণ মামলার দায় হতে অব্যাহতি প্রার্থনা করেন।
সাকলায়েনের বিভাগীয় মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি, অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক লিখিত জবাব, মৌখিক বক্তব্য ও অন্যান্য কাগজপত্রাদি পুনরায় বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়। সার্বিক পর্যালোচনাস্তে ২য় কারণ দর্শানোর জবাব সন্তোষজনক বিবেচিত না হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী অসদাচরণ এর অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েনক বিধি ৪ এর উপ-বিধি ৩(খ) বিধি মোতাবেক গুরুদণ্ড হিসেবে চাকুরী হতে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান এর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
উপসচিবের আবেদনের সর্বশেষ বলা হয়, সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী অসদাচরণ এর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় একই বিধিমালার বিধি ৪ এর উপ-বিধি ৩(খ) বিধি মোতাবেক গুরুদণ্ড হিসেবে চাকরি হতে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান দণ্ডের বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়।
যেভাবে ঘনিষ্ঠতা
পরীমণির সঙ্গে এডিসি গোলাম মোহাম্মদ সাকলায়েনের সম্পর্কের উপলক্ষ এক মামলার তদন্ত। ২০২১ সালের জুনে। ১৩ জুন উত্তরা বোট ক্লাবে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদের বিরুদ্ধে মামলা করেন পরীমণি। পরদিন উত্তরা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ।
ওই সময় পরীমণিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয় গোয়েন্দা কার্যালয়ে। তখনই পরীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় সাকলায়েনের। এরপর দ্রুতই সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে। পরীমনি-কাণ্ডের পর খবর বেরোয়- এই নায়িকার সঙ্গে প্রায়ই রাতে বিভিন্ন স্থানে দেখা যেত এডিসি সাকলায়েনকে। রাত গভীর হলে গাড়ি নিয়ে বের হতেন তারা। মাঝেমধ্যে পরীমণির বাসায়ও যেতেন সাকলায়েন।
সর্বশেষ পরীমণি সাকলায়েনের বাসায় গিয়ে প্রায় ১৮ ঘণ্টা সময় কাটান। এরপর জনসমক্ষে তাদের ঘনিষ্ঠতার চিত্র। সিসিটিভির ফাঁস হওয়া দৃশ্য ২০২১ সালের ১ আগস্ট রাত আটটার দিকে চিত্রনায়িকা পরীমণিকে নিয়ে নিজ বাসায় অবস্থান করেন গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম মোহাম্মদ সাকলায়েন।
সিসি ফুটেজে দেখা যায়, রাত আটটার দিকে রাজারবাগের মধুমতি ভবনের সামনে থামে পরীমণির হ্যারিয়ার গাড়ি। ওই ভবনের ১০ তলায় সাকলায়েনের সরকারি বাসা। সাকলায়েন নিজে নেমে এসে রিসিভ করেন পরীমণিকে। এর কিছুক্ষণ পর সাকলায়েনের বাসায় প্রবেশ করেন পরীমনির খালাতো বোন ও তার স্বামী। পরে রাত দুইটার দিকে পরীমণিসহ তিনজনই বের হয়ে যান বাসা থেকে। ঘটনার বেশ কিছু দিন পর ফাঁস হয় এই ফুটেজ। এর আগে বনানীর বাসায় অভিযান চালিয়ে পরীমনিকে বিপুল পরিমাণ মাদকদসহ গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।